সূরা আল-বাকারাহ : আয়াত: ১৯০-১৯২

১৯০. আর তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ করো, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে(1), কিন্তু বাড়াবাড়ি করো না। কারণ যারা বাড়াবাড়ি করে, আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না(2)

1. এটি পবিত্র কুরআনে ‘জিহাদ’ তথা ‘আল্লাহর পথে সর্বাত্মক সাধনা-সংগ্রাম-যুদ্ধ’ সম্পর্কিত প্রথম আয়াত এবং এর সম্পুরক হিসেবে অবতীর্ণ হয় সূরা আত-তাওবার এ আয়াতটি:

আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন। সূরা আত-তাওবাহ: ৩৬

আল্লাহর পথে চলতে যারা পথরোধ করে দাঁড়ায় এবং আল্লাহ-প্রদত্ত জীবন বিধান অনুযায়ী জীবন ব্যবস্থার সংস্কার ও সংশোধন করতে চাইলে যারা শত্রু হয়ে দাঁড়ায় এবং একাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য জুলুম-অত্যাচার চালায় ও শক্তি প্রয়োগ করে, তাদের বিরূদ্ধে এ যুদ্ধের নির্দেশ। এর আগে মুসলমানরা যতদিন দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ছিল, তাদেরকে কেবলমাত্র ইসলাম প্রচারের হুকুম দেয়া হয়েছিল এবং বিপক্ষের জুলুম-নির্যাতনে সবর করার তাকীদ করা হচ্ছিল। এখন মদীনায় তাদের একটি ছোট্ট স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই প্রথমবার তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, যারাই এই সংস্কারমূলক দাওয়াতের পথে সশস্ত্র প্রতিরোধ সৃষ্টি করছে, অস্ত্র দিয়েই তাদের আক্রমণের জবাব দাও। এরপরই অনুষ্ঠিত হয় বদরের যুদ্ধ।


একটি প্রাসঙ্গিক হাদীস: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)কে জিজ্ঞেস করলাম, হে রাসূলুল্লাহ! কোন কাজটি সবচেয়ে ভাল? তিনি (সা) বললেন, নির্ধারিত সময়ে নামায আদায় করা। আমি বললাম, তারপর কোন কাজটি ভাল? তিনি বললেন, পিতা-মাতার সেবা করা। আমি আবারও বললাম, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা)কে আর কোনো কথা জিজ্ঞেস না করে আমি চুপ থাকলাম। যদি আমি প্রশ্ন আরও বাড়াতাম, তবে তিনি তারও জবাব দিতেন।


সহীহ আল-বুখারী, ৩য় খন্ড, কিতাবুল জিহাদ, হাদীস নং- ২৫৭৬



2. অর্থাৎ বস্তুগত স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে এ যুদ্ধ নয়। আল্লাহ প্রদত্ত সত্য সঠিক জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না তাদের উপর কোনো হস্তক্ষেপ নয়। যুদ্ধের ব্যাপারে অজ্ঞতার যুগের পদ্ধতি অবলম্বন করবে না। নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও আহতদের গায়ে হাত ওঠানো, শত্রু পক্ষের নিহতদের লাশের চেহারা বিকৃত করা, শস্যক্ষেত ও গবাদি পশু অযথা ধ্বংস করা এবং অন্যান্য যাবতীয় জুলুম ও বর্বরতামূলক কর্মকাণ্ড ‘বাড়াবাড়ি’ এর অন্তর্ভূক্ত। হাদীসে এসবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। আয়াতের মূল বক্তব্য হচ্ছে, একমাত্র অপরিহার্য ক্ষেত্রেই শক্তির ব্যবহার করতে হবে এবং ঠিক ততটুকু পরিমাণ ব্যবহার করতে হবে যতটুকু সেখানে প্রয়োজন।


وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ وَأَخْرِجُوهُم مِّنْ حَيْثُ أَخْرَجُوكُمْ وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ وَلاَ تُقَاتِلُوهُمْ عِندَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ حَتَّى يُقَاتِلُوكُمْ فِيهِ فَإِن قَاتَلُوكُمْ فَاقْتُلُوهُمْ كَذَلِكَ جَزَاء الْكَافِرِينَ

১৯১. তাদের সাথে যেখানেই তোমাদের মোকাবিলা হয় তোমরা যুদ্ধ করো এবং তাদের উৎখাত করো সেখান থেকে – যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে উৎখাত করেছে। কারণ হত্যা যদিও খারাপ, ফিতনা তার চেয়েও বেশী খারাপ (3) আর মাসজিদে হারামের কাছে যতক্ষণ তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ না করে, তোমরাও যুদ্ধ করো না (4) কিন্তু যদি তারা সেখানে যুদ্ধ করতে সংকোচবোধ না করে, তাহলে তোমরাও নিঃসংকোচে তাদেরকে হত্যা করো। কারণ এটাই এই ধরনের কাফেরদের যোগ্য শাস্তি।


3. এখানে ‘ফিতনা’ শব্দটি ঠিক সেই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যে অর্থে ইংরেজীতে Persecution শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি বা দল প্রচলিত চিন্তাধারা ও মতবাদের পরিবর্তে অন্য কোন চিন্তা ও মতবাদকে সত্য হিসেবে জানার কারণে তাকে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং সমালোচনা ও প্রচারের মাধ্যমে সমাজে বর্তমান প্রচলিত ব্যবস্থার সংশোধনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে, নিছক এ জন্য তার উপর জুলুম-নির্যাতন চালানো।

আয়াতের মূল বক্তব্য হচ্ছে: নরহত্যা নিঃসন্দেহে একটি জঘণ্য কাজ, কিন্তু কোন গোষ্ঠী বা দল যখন জোরপূর্বক নিজের স্বৈরতান্ত্রিক ও যুলুমতান্ত্রিক চিন্তাধারা অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়, সত্য গ্রহণ থেকে লোকদেরকে জোরপূর্বক বিরত রাখে এবং যুক্তির পরিবর্তে পাশবিক শক্তি প্রয়োগে জীবন গঠন ও সংশোধনের বৈধ ও ন্যায়সংগত প্রচেষ্টার মোকাবিলা করতে শুরু করে তখন সে নরহত্যার চাইতেও জঘণ্যতম অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়। এই ধরনের গোষ্ঠি বা দলকে অস্ত্রের সাহায্যে পথ থেকে সরিয়ে দেয়া যে সম্পূর্ণ বৈধ ও ন্যায়সংগত তাতে সন্দেহ নেই।


4. একটি প্রাসঙ্গিক হাদীস: আবু বাকরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, বিদায় হজ্জে কোরবানীর দিন রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের সামনে খুতবা দিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জানো এটি কোন দিন? আমরা সবাই বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সর্বাধিক অবগত। নবী (সা) কিছু সময় চুপ থাকলেন। এমনকি আমরা ধারণা করলাম, তিনি হয়তো এর নাম পাল্টিয়ে নতুন নাম রাখবেন। তিনি বললেন, এটা কি কোরবানীর দিন নয়? আমরা বললাম, হাঁ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ মাসটি কোন মাস? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সর্বাধিক অবগত। তিনি কিছু সময় চুপ থাকলেন, এমনকি আমরা ধারণা করে নিলাম, তিনি হয়তো এর নাম পাল্টিয়ে নতুন নামকরণ করবেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এটি কি যিলহজ্জ মাস নয়? আমরা বললাম, হাঁ। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এটি কোন শহর? আমরা সবাই বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সর্বাধিক অবগত। তিনি কিছুক্ষণ চুপ রইলেন, এমনকি আমরা ধারণা করে নিলাম যে, তিনি এর নাম পাল্টিয়ে নতুন নামকরণ করবেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি মহাসম্মানিত শহর নয়? আমরা সবাই বললাম, হাঁ। তিনি বললেন, তোমাদের রক্ত ও সম্পদ তোমাদের এই শহর, এই মাস ও এই দিনের মতই ততদিন পর্যন্ত মহান ও মর্যাদাসম্পন্ন, যতদিন না তোমরা তোমাদের প্রভুর সাথে সাক্ষাত লাভ করবে। তাহলে আমি কি (সবকিছু) তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি? উপস্থিত সবাই বললো, হাঁ। এ সময় তিনি বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো। আর (সাহাবাদের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন) তোমাদের উপস্থিত লোকদের উচিত অনুপস্থিতদের কাছে এ বাণী পৌঁছিয়ে দেয়া, কেননা যাদের কাছে পৌঁছানো হবে, তাদের মধ্যে অনেক ব্যক্তি এমন থাকে যে বর্ণনাকারীর চেয়ে সংরক্ষণের দিক থেকে অধিক যোগ্য। আর তোমরা কিন্তু আমার পর কাফের হয়ে যেও না অর্থাৎ কুফুরী আচরণে তৎপর হয়ো না।

দেখুন: সহীহ আল-বুখারী, ২য় খন্ড, কিতাবুল হজ্জ, হাদীস নং- ১৬২১


فَإِنِ انتَهَوْاْ فَإِنَّ اللّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

১৯২. তারপর যদি তারা বিরত হয়, তাহলে জেনে রাখো আল্লাহ ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী(5)।


৫. অর্থাৎ তোমরা যে আল্লাহর উপর ঈমান এনেছো তিনি নিকৃষ্টতম অপরাধী ও পাপীকেও মাফ করে দেন, যদি সে তার বিদ্রোহাত্মক আচরণ পরিহার করে, এটিই তাঁর গুণ-বৈশিষ্ট্য। এই গুণ-বৈশিষ্ট্য তোমরা নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করো। ‘আল্লাহর চারিত্রিক গুণ-বৈশিষ্ট্যে নিজেদেরকে সজ্জিত করো’- রাসূলুল্লাহ সা:এর এ বাণীর তাৎপর্যও এটিই। প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করার জন্য মুসলমানগণ যুদ্ধ করবে না। তারা যুদ্ধ করবে আল্লাহর দীনের পথকে সুগম করার জন্যে। কোনো গোষ্ঠি বা শক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ততক্ষণ তারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; কিন্তু যখনই সে নিজের প্রতিবন্ধকতার নীতি পরিহার করবে তখনই মু’মিনেরা তার উপর থেকে হাত গুটিয়ে নেবে।

No comments:

Post a Comment