সূরা আল-বাকারাহ : আয়াত: ১৯৩

১৯৩. তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয়ে যায় এবং দীন (জীবন-ব্যবস্থা) একমাত্র আল্লাহর জন্য নিদিষ্ট হয়ে যায়(1) তারপর যদি তারা বিরত (2) হয় তাহলে জেনে রাখো, যালেমদের ছাড়া আর করোর উপর হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয় (3)

.......................................................


(1). ইতিপূর্বে ‘ফিতনা’ শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, এখানে তা থেকে একটু স্বতন্ত্র অর্থে তার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। পূর্বাপর আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, এখানে ‘ফিতনা’ বলতে এমন অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে যখন ‘দীন’ অর্থাৎ ‘জীবন-ব্যবস্থা’ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্তার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায় এবং এ ক্ষেত্রে যুদ্ধের একমাত্র উদ্দেশ্যই হয় ফিতনাকে নির্মুল করে দীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া।

আবার ‘দীন’ শব্দটির তাৎপর্য অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, আরবী ভাষায় দীন অর্থ হচ্ছে ‘আনুগত্য’ এবং এর পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে ‘জীবন-ব্যবস্থা’। এমন একটি জীবন-ব্যবস্থা যেখানে কোন সত্তাকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে মেনে নিয়ে তার প্রদত্ত বিধান ও আইনের আনুগত্য করা হয়। দীনের এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে একথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সমাজে যখন মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্ব ও সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন সমাজের এই অবস্থাকে ‘ফিতনা’ বলা হয়। এই ফিতনার জায়গায় এমন একটি ব্যবস্থার সৃষ্টি করা ইসলামী জিহাদের লক্ষ্য, যেখানে মানুষ একমাত্র আল্লাহর বিধানের অনুগত থাকবে।


একটি প্রাসঙ্গিক হাদীস:


ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমাকে (আল্লাহর তরফ থেকে) হুকুম করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর রাসূল; আর নামায কায়েম করে এবং যাকাত দেয়। তারা যখন ওগুলো করবে, তখন আমার (হাত) থেকে তারা ইসলামের হক বাদে# নিজেদের রক্ত ও ধন বাঁচাতে পারবে। আর তাদের (কাজের) হিসাব আল্লাহর কাছে থাকবে।

# এখানে রক্ত সম্বদ্ধে ইসলামের হক তিনটি: (১) অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে (২) বিবাহের মাধ্যমে যৌন মিলন হওয়ার পর যিনা করলে এবং (৩) ইসলাম ত্যাগ করলে মৃত্যুর শাস্তি দেয়া ইসলামের হক। আর ধন সম্বন্ধে ইসলামের হক হচ্ছে যাকাত।


দেখুন: সহীহ আল-বুখারী, ১ম খন্ড, কিতাবুল ঈমান, হাদীস নং- ২৪


(2). এখানে ‘বিরত’ হওয়ার অর্থ কাফেরদের নিজেদের কুফরী বা শির্ক থেকে বিরত হওয়া নয়। বরং ফিতনা সৃষ্টি করা থেকে বিরত হওয়া। কাফের, মুশরিক, নাস্তিক প্রত্যেকের নিজেদের ইচ্ছামত আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করার অধিকার আছে। তারা যার ইচ্ছে তার ইবাদাত-উপাসনা করতে পারে। অথবা চাইলে কারোর ইবাদাত নাও করতে পারে। তাদেরকে এই গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা থেকে বের করে আনার জন্য উপদেশ দিতে হবে, অনুরোধ করতে হবে। কিন্তু এ জন্য তাদের সাথে যুদ্ধ করা যাবে না। তবে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য বিধি-বিধান মানতে লোকদেরকে জুলুমপূর্বক বাধ্য করার এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহ ছাড়া আর কারোর বান্দায় পরিণত করার অধিকার তাদের নেই। এই ফিতনা নির্মূলের জন্য সম্ভাব্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আর কাফের ও মুশরিকরা এই ফিতনা থেকে বিরত না হওয়া পর্যন্ত মু’মিন তার এ সংগ্রাম-সাধনা থেকে নিশ্চেষ্ট ও নিবৃত্ত হবে না।


(3). এখানে ‘জালেমদের ছাড়া আর কারোর উপর হস্তক্ষেপ বৈধ হবে না’– একথা থেকে এই ইংগিত পাওয়া যায় যে, বাতিল জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তে সত্য জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পর সাধারণ লোকদের মাফ করে দেয়া হবে। কিন্তু নিজেদের শাসনামলে যারা সত্যের পথ রোধ করার জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছিল, সত্যপন্থীরা তাদেরকে অবশ্যি শাস্তিদান করতে পারবে। যদিও ক্ষমা করে দেয়া এবং বিজয় লাভের পর জালেমদের থেকে প্রতিশোধ না নেয়াই সৎকর্মশীল মু’মিনদের জন্য শোভনীয়, তবুও যাদের অপরাধের তালিকা অনেক বেশী কালিমা লিপ্ত – তাদেরকে শাস্তি দেয়া একান্তই বৈধ। মহানবী (সা) নিজেও তা করেছেন – অথচ তাঁর চেয়ে বেশী ক্ষমা ও উদারতা আর কে প্রদর্শন করতে পারে? তাই দেখা যায়, বদরের যুদ্ধের বন্দীদের মধ্য থেকে উকবাহ ইবনে আবী মুয়ীত ও নযর ইবনে হারিসকে তিনি হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। আবার মক্কা বিজয়ের পর ১৭ জন লোককে সাধারণ ক্ষমার বাইরে রেখেছেন এবং তাদের মধ্য থেকে চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন – যার সবই আল্লাহ-প্রদত্ত নির্দেশ ও অনুমতির বাস্তব প্রতিফলন।

No comments:

Post a Comment