(সুরা জ্বিন: ১-৭) : জাহেলী যুগে আরবরা জনহীন প্রান্তরে উচ্চস্বরে বলতো, "আমরা এ প্রান্তরের অধিপতি 'জিনের' আশ্রয় প্রার্থনা করছি"



১) হে নবী ,বল, আমার কাছে অহী পাঠানো হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ দিয়ে শুনেছে৷ ১   তারপর (ফিরে গিয়ে নিজ জাতির লোকদেরকে ) বলেছেঃ"আমরা এক বিস্ময়কর "কুরআন"শুনেছি ২  


 ১ . এ থেকে জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সময় জিনদের দেখতে পাচ্ছিলেন না এবং তারা যে কুরাআন শুনছে একথাও তাঁর জানা ছিল না৷ পরবর্তী সময়ে আল্লাহ তাআলা তাঁকে অহীর মাধ্যমে এ ঘটনা জানিয়ে দিয়েছেন৷ এ ঘটনাটি বর্ণনা প্রসংগে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস স্পস্টভাবে বলেছেন যে, সে সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিনদের উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করনেনি এবং তিনি তাদের দেখেনওনি৷" (মুসলিম ,তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে জারীর)

২ . মূল আয়াতে -------(কুরআনান আজাবান)শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে৷"কুরআন" মানে পড়ার মত জিনিস৷ জিনেরা সম্ভবত শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহার করেছিল৷ কারণ তখন তারা প্রথম বারের মত এ বাণীর সাথে পরিচিত হয়েছিল৷ সে সময় হয়তো তাদের জানা ছিল না যে, যে জিনিস তারা শুনছে তার নামই কোরআন৷ ------(আজাবা)আধিক্য অর্থ নির্দেশক একটি শব্দ৷ আরবী ভাষায় শব্দটি ব্যবহৃত হয় অত্যাধিক বিস্ময়কর ব্যাপার বুঝাতে ৷ সুতরাং জিনদের উক্তির অর্থ হলো, আমরা এমন একটি বাণী শুনে এসেছি যা ভাষাগত উৎকর্ষতা ও বিষয়বস্তু অতুলনীয়৷

এ থেকে জানা যায় যে, জিনরা শুধু মানুষের কথা শুনতে পারে তাই নয়, তারা মানুষের ভাষাও ভালভাবে বুঝতে পারে৷ তবে এটা জরুরী নয় যে, সব জিন মানুষের সব ভাষাই জানবে বা বুঝবে৷ সম্ভবত তাদের যে গোষ্ঠি পৃথিবীর যে এলাকায় বসবাস করে তারা সে এলাকার মানুষের ভাষা জানে৷তবে কুরআনের এ বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ঐ সময় যেসব জিন কুরাআন শুনেছিল তারা আরবী ভাষায় এত দক্ষ ছিল যে, তারা এ বাণীর অতুলনীয় ভাষাগত উৎকর্ষ পর্যন্ত উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল এবং এর উচ্চমানের বিষয়বস্তু ও ভালভাবে বুঝতে পেরেছিল৷


২) যা সত্য ও সঠিক পথের নির্দেশনা দেয় তাই আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি এবং আমরা আর কখনো আমাদের রবের সাথে কাউকে শরীক করবো না৷"   


৩) আর "আমাদের রবের মর্যাদা অতীব সমুচ্চ ৷ তিনি কাউকে স্ত্রী কিংবা সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেননি৷" ৩  


৩ . এখান থেকে দুটি বিষয় জানা গেল৷ এ জিনগুলো হয় ঈসায়ী বা খৃষ্ট ধর্মের অনুসারী ছিল অথবা অন্য এমন কোন ধর্মের অনুসারী ছিল যে ধর্মে মহান আল্লাহর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে বলে বিশ্বাস করা হতো ৷ দুটি, সে সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযের মধ্যে পবিত্র কুরআনের এমন কোন অংশ তিলাওয়াত করছিলেন যা শুনে তাদের কাছে নিজেদের আকীদার ভ্রান্তি ধরা পড়েছিল৷ এবং তারা বুঝতে পেরেছিল যে, মহান আল্লাহর সমুন্নত ও অতি মর্যাদাবান সত্তার সাথে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে সম্পর্কিতও করা চরম অজ্ঞতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ৷


৪) আর "আমাদের নির্বোধ লোকেরা ৪   আল্লাহ সম্পর্কে সত্য ও ন্যায়ের পরিপন্থী অনেক কথাবার্তা বলে আসছে৷"  


৪ . মূল আয়াতে --------(ছাফিহুনা)শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে৷ এ শব্দটি এক ব্যক্তির জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে আবার অনেক লোক বা দলের জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে৷ যদি শব্দটি একজন অজ্ঞ বা মূর্খ লোক অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে তার মানে হবে ইবলীস৷ আর যদি অনেক লোক বা দলের অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে অর্থ হবে জিনদের মধ্য থেকে অনেক নির্বোধ ও বুদ্ধি -বিবেকহীন লোক এ রকম কথা বলতো৷

৫) আর "আমরা মনে করেছিলাম যে, মানুষ এবং জিন আল্লাহর সম্বন্ধে কখনো মিথ্যা বলতে পারে না৷" ৫  


৫ . অর্থাৎ তাদের ভ্রান্ত কথাবার্তা দ্বারা আমাদের বিভ্রান্ত হওয়ার কারণ হলো, আমরা কোন সময় চিন্তাও করতে পারিনি যে, মানুষ কিংবা জিন আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলার দুঃসাহসও করতে পারে কিন্তু এখন এ কুরআন শুনে আমরা জানতে পেরেছি যে, প্রকৃত পক্ষে তারা ছিল মিথ্যাবাদী৷

৬) আর "মানুষের মধ্য থেকে কিছু লোক জিনদের কিছু লোকের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতো৷ এভাবে তারা জিনদের অহংকার আরো বাড়িয়ে দিয়েছে৷"৬  


৬ . ইবনে আব্বাস বলেনঃ জাহেলী যুগে আরবরা যখন কোন জনহীন প্রান্তরে রাত্রি যাপন করতো তখন উচ্চস্বরে বলতো, <span>"আমরা এ প্রান্তরের অধিপতি জিনের আশ্রয় প্রার্থনা করছি৷"</span>জাহেলী যুগের অন্যান্য বর্ণনাতেও এ বিষয়টির বহুল উল্লেখ দেখা যায়৷ উদাহরণ স্বরূপ ,<span> কোন জায়গায় পানি এবং ঘাস ফুরিয়ে গেলে মুরুচারী যাযাবর বেদুঈনরা তাদের একজন লোককে এমন আরেকটি জায়গা খুঁজে বের করতে পাঠাতো যেখানে পানি এবং ঘাস পাওয়া যেতে পারে৷ অতপর উক্ত ব্যক্তির নির্দেশনা মুতাবিক এসব লোক নতুন জায়গায় পৌছলে সেখানে অবস্থান নেয়ার আগে চিৎকার করে বলতোঃ আমরা এ প্রান্তরের মালিকের আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যাতে আমরা এখনে সব রকম বিপদ থেকে নিরাপদে থাকতে পারি৷ </span>" তাদের বিশ্বাস ছিল , প্রত্যেক জনমনবহীন জায়গা কোন না কোন জিনের দখলে আছে৷ তার আশ্রয় প্রার্থনা ছাড়াই কেউ যদি সেখানে অবস্থান করে তাহলে সে জিন হয় নিজেই তাদের উত্যক্ত করে কিংবা অন্য জিনদের উত্যক্ত করার জন্য লেলিয়ে দেয়৷ ঈমান আনয়নকারী এ জিনরা এ বিষয়টির প্রতিই ইংগিত করেছে৷ তাদের কথার অর্থ হলো এ পৃথিবীর খলিফা বা প্রতিনিধি মানুষ৷ তারাই যখন উল্টা আমাদের ভয় করতে শুরু করেছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাদের আশ্রয় প্রার্থনা করতে শুরু করেছে তখন আমাদের জাতির লোকদের মস্তিষ্ক বিকৃতি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে৷ তাদের গর্ব, অহংকার এবং কুফরী ও জুলুম অত্যাচারের মাত্রা অত্যাধিক বেড়ে গিয়েছে এবং গোমরাহীর ক্ষেত্রে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে গিয়েছে৷

৭) আর "তোমরা যেমন ধারণা পোষণ করতে মানুষেরাও ঠিক তেমনি ধারণা পোষণ করেছিল যে, আল্লাহ কাউকে রসূল বানিয়ে পাঠাবেন না৷" ৭ 


৮ . এ আয়াতাংশের দুটি অর্থ হতে পারে৷ একটি আমরা যা অনুবাদ করেছি৷ অপরটি হলো,"মৃত্যুর পর আল্লাহ তা"আলা কাউকে আর জীবিত করে উঠাবেন না৷" যেহেতু কথাটি ব্যাপক অর্থবোধক তাই তার এ অর্থও গ্রহণ করা যেতে পারে যে মানুষের মত জিনদের মধ্যে একদল আখেরাতকে অস্বীকার করতো৷ কিন্তু পরবর্তী বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যের দিক থেকে প্রথম অর্থটিই অধিক অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য৷ কারণ, পরবর্তী আয়াতসমূহে এ বিষয়টির ঊল্লেখ আছে যে,ঈমান আনয়নকারী এসব জিন তাদের কওমকে বলছে, আল্লাহ আর কোন রসূল পাঠাবেন না ৷ তোমাদের এ ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে৷ আমাদের জন্য আসমানের দারজা বন্ধ করার কারণ হলো আল্লাহ একজন রসল পাঠিয়েছেন৷

No comments:

Post a Comment