১৫) আর যারা ন্যায় ও সত্য থেকে বিমুখ তারা হবে জাহান্নামের ইন্ধন৷ ১৪
১৪ . কুরআনের ভাষ্য অনুসারে জিনেরা আগুন থেকে সৃষ্ট৷ তাই প্রশ্ন হতে হতে পারে যে, জাহান্নামের আগুন দ্বারা তাদের আবার কি কষ্ট হবে? এর জবাব হলো, কুরআনের ভাষ্য অনুসারে মানুষ ও মাটি থেকে সৃষ্ট৷ তা সত্ত্বেও তাদের <span>মাটির ঢিল ছুঁড়ে মারলে ব্যাথা পায় কেন?</span> প্রকৃত সত্য হলো মানুষের গোটা দেহ মাটির উপাদান দ্বারা তৈরী হলেও এসব উপাদান থেকে যখন একজন রক্ত-মাংসের জীবন্ত মানুষ অস্তিত্ব লাভ করে তখন সে এসব উপাদান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিসে রূপান্তরিত হয় এবং একই উপাদান থেকে তৈরী অন্যান্য জিনিস তার কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ ঠিক তেমনিভাবে গঠনাকৃতির দিক থেকে জিন যদিও আগুণের তৈরী৷ কিন্তু আগুণ থেকে তৈরী একটি জীবন্ত ও চেতনা সম্পন্ন সৃষ্টি যখন অস্তিত্ব লাভ করে তখন সে আগুনই তার জন্যের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ (<span>অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমূল কোরআন, সূরা আর রহমান, টীকা ১৫</span>)
সূরা আর রহমান
১৫) আর জিনদের সৃষ্টি করেছেন আগুণের শিখা থেকে ৷১৫
১৫. মূল আয়াতে যে কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে৷ ( ) অর্থ এক বিশেষ ধরনের আগুন৷ কাঠ বা কয়লা জ্বালালো যে আগুন সৃষ্টি এটা সে আগুন নয়৷ আর ( ) অর্থ ধোঁয়াবিহীন শিখা৷ এ কথার অর্থ হচ্ছে প্রথম মানুষকে যেভাবে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তারপর সৃষ্টির বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করার সময় তার মাটির সত্তা অস্থি-মাংসে তৈরী জীবন্ত মানুষের আকৃতি লাভ করেছে এবং পরবর্তী সময়ে শুক্রের সাহায্যে তার বংশধারা চালু আছে৷ অনুরূপ প্রথম জিনকে নিছক আগুনের শিখা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল৷ এবং তার বংশধরদের থেকে পরবর্তী সময়ে জিনদের অধস্তন বংশধররা সৃষ্টি হয়ে চলেছে৷ মানব জাতির জন্য আদমের মর্যাদা যা, জিন জাতির জন্য সেই প্রথম জিনের মর্যাদাও তাই৷ জীবন্ত মানুষ হয়ে যাওয়ার পর হযরত আদম এবং তার বংশ থেকে জন্ম লাভকারী মানুষের দেহের সেই মাটির সাথে যেমন কোন মিল থাকলো না যে মাটি দ্বারা তাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল৷ যদিও এখানো আমাদের দেহে পুরোটাই মাটির অংশ দ্বারাই গঠিত৷ কিন্তু মাটির ঐ সব অংশ রক্ত-মাংসের রূপান্তরিত হয়েছে এবং প্রাণ সঞ্চরিত হওয়ার পর তা শুধু মাটির দেহ না থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিসে রূপান্তরিত হয়েছে৷ জিনদের ব্যাপারটিও তাই৷ তাদের সত্তাও মূলত আগুনের সত্তা৷ কিন্তু আমরা যেমন মাটির স্তুপ নই, অনূরূপ তারাও শুধু অগ্নি শিখা নয়৷
এ আয়াত থেকে দুটি দু'টি বিষয় জানা যায়ঃ এক, জিনেরা, নিছক আত্মিক সত্তা নয়, বরং তাদেরও এক ধরনের জড় দেহ আছে৷ তবে তা যেহেতু নিরেট আগুনের উপাদানে গঠিত তাই তারা মাটির উপাদানে গঠিত মানুষের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না৷ নীচে বর্ণিত এ আয়াতটি এ বিষয়ের প্রতিই ইংগিত করেঃ
------
"শয়তান ও তার দলবল এমন অবস্থান থেকে তোমাদের দেখছে যেখানে তোমরা তাদের দেখতে পাও না" ( আল আ'রাফ-২৭) ৷
অনুরূপভাবে জিনদের দ্রুত গতিসম্পন্ন হওয়া, অতি সহজেই বিভিন্ন আকার-আকৃতি গ্রহণ করা এবং যেখানে মাটির উপাদানে গঠিত বস্তুসমূহ প্রবেশ করতে পারে না, কিংবা প্রবেশ করলেও তা অনুভূত হয় বা দৃষ্টি গোচর হয়, সেখানে তাদের প্রবেশ অনুভূত বা দৃষ্টিগোচর না হওয়া -এসবই এ কারণে সম্ভব ও বোধগম্য যে, প্রকৃতই তারা আগুনের সৃষ্টি৷
এ থেকে দ্বিতীয় যে বিষয়টি জানা যায় তা হচ্ছে, জিনরা মানুষ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সৃষ্টিই শুধু নয়, বরং তাদের সৃষ্টি উপাদানই মানুষ, জীবজন্তু, উদ্ভিদরাজি এবং চেতনা পদার্থসমূহ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ যারা জিনদেরকে মানুষেরই একটি শ্রেনী বলে মনে করে এ আয়াত স্পষ্ট ভাষায় তাদের ভ্রান্তি প্রমাণ করছে৷ তারা এর ব্যাখ্যা করে বলেন, মাটি থেকে মানুষকে এবং আগুন থেকে জিনকে সৃষ্টি করার অর্থ প্রকৃত পক্ষে দুই শ্রেনীর মানুষের মেজাজের পার্থক্য বর্ণনা করা ৷ এক প্রকারের মানুষ নম্র মেজাজের হয়ে থাকেন৷ সত্যিকার অর্থে তারাই মানুষ৷ আরেক প্রকারের মানুষের মেজাজ হয় অগ্নিষ্ফুলিঙ্গের মত গরম৷ তাদের মানুষ না বলে শয়তান বলাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত৷ তবে এ ধরনের ব্যাখ্যা প্রকৃতপক্ষে কুরআনের তাফসীর নয়, কুরআনের বিকৃত সাধন করা৷ উপরে ১৪ নম্বর টীকায় আমরা দেখিয়েছি যে, কুরআন নিজেই মাটি দ্বারা মানুষের সৃষ্টির অর্থ কতটা স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে৷ বিস্তারিত এসব বিবরণ পড়ার পর কোন বিবেকবান ব্যক্তি কি এর এ অর্থ গ্রহণ করতে পারে যে, এসব কথার উদ্দেশ্য শুধু উত্তম মানুষের নম্র মেজাজ হওয়ার প্রশংসা করা? তার পরেও সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষের মগজে একথা কি করে আসতে পারে যে, মানুষকে পঁচা আঠাল মাটির শুকনো ঢিলা থেকে সৃষ্টি করা এবং জিনদেরকে নিরেট অগ্নি শিখা থেকে সৃষ্টি করার অর্থ একই মানব জাতির দুটি ভিন্ন ভিন্ন মেজাজের ব্যক্তিদের বা গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র নৈতিক গুণাবলীর পার্থ্যক্য বর্ণনা করা?
১৬) আর ১৫ (হে বনী, বলে দাও, আমাকে অহীর মাধ্যমে এও জানানো হয়েছে যে,) লোকেরা যদি সঠিক পথের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকতো তাহলে আমি তাদের প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণের মধ্যে সমৃদ্ধ করতাম৷ ১৬
১৫ . এর পূর্বে জিনদের কথা শেষ হয়ে গিয়েছে৷ এখন এখান থেকে আল্লাহ তা"আলা নিজের কথা শুরু হচ্ছে৷
১৬ . একথাটিই সুরা নূহে এভাবে বলা হয়েছে ,"তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তোমাদের ওপর আসমান থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন৷"(ব্যাখ্যার জন্য দেখুন,তাফহীমুল কুরআন, সূরা নূহ ,টীকা ২) প্রচুর পরিমাণ পানিকে নিয়ামতের প্রাচুর্য অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে৷ কেননা, পানির ওপর নির্ভর করেই জনবসতি গড়ে উঠে৷ পানি না থাকলে মৌলিক প্রয়োজন যেমন পূর্ণ হয় না তেমনি মানুষের বিভিন্ন রকম শিল্পও গড়ে উঠতে পারে না৷
১৭) যাতে এ নিয়ামতের মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা করতে পারি৷ ১৭ আর যারা তাদের প্রভূর স্মরণ থেকে বিমুখ হবে ১৮ তিনি তাদের কঠিন আযাবে নিক্ষেপ করবেন৷
১৭ . অর্থাৎ তিনি দেখতে চান তারা নিয়ামত লাভ করার পর কৃতজ্ঞ থাকে কিনা এবং আমার দেয়া নিয়ামসমূহ সঠিক ভাবে কাজে লাগায় , না ভ্রান্ত পথে কাজে লাগায়৷
১৮ . স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার একটা অর্থ হলো, মানুষ আল্লাহর প্রেরিত উপদেশ গ্রহণ করবে না৷ আরেকটি অর্থ হলো, মানুষ আল্লাহর যিকরের কথা শোনা পছন্দ করবে না৷ এর আরেকটি অর্থ হলো, সে আল্লাহর ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে৷
১৮) আর মসজিদসমূহ আল্লাহর জন্য৷ তাই তোমরা আল্লাহর সাথে আর কাউকে ডেকো না ৷ ১৯
১৯ . মুফাস্সিরগণ (মাছাজিদ) শব্দটি সাধারণভাবে ইবাদতখানা বা উপসানলায় অর্থে গ্রহণ করেছেনঃ "মাসাজিদ" শব্দটি এ অর্থ গ্রহণ করলে আয়াতটির অর্থ হয় "উপাসনালয় সমূহে আল্লাহর ইবাদতের সাথে সাথে আর কারো ইবাদত যেন করা না হয়৷ হযরত হাসান বাসরী বলেনঃ সমস্ত পৃথিবীটাই ইবাদতখানা বা উপাসনালয়৷ তাই আয়াতটির মূল বক্তব্য হলো আল্লাহর এ পৃথিবীতে কোথাও যেন শিরক করা না হয়৷ তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণী থেকে প্রমাণ পেশ করেছেন -----------------(<span>আমার জন্য সমগ্র পৃথিবীকে ইবাদতের স্থান এবং পবিত্রতা অর্জনের উপায় বানিয়ে দেয়া হয়েছে)৷</span>
হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর মসজিদ বলতে যেসব অংগ -প্রত্যংগের সাহায্যে মানুষ সিজদা কর সেগুলো অর্থাৎ হাত,হাঁটু, পা ও কপাল বুঝিয়েছেন৷ এ ব্যাখ্যা অনুসারে আয়াতটির অর্থ হলো, সমস্ত অংগ-প্রত্যংক আল্লাহর তৈরী ৷ এগুলোর সাহায্যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সিজদা করা যাবে না৷
No comments:
Post a Comment